শিরোনাম
‘অপারেশন সার্চ লাইটে’ তারা সেদিন ঢাকা মহানগরের কয়েক হাজার মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল রেললাইনের পাশে থাকা বস্তি, ইংলিশ রোড আর নয়াবাজারের কাঠ আর টিনের দোকানগুলোতে, হিন্দু মহল্লা শাঁখারীপট্টিতে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল ছিল তাদের টার্গেটকিন্তু সেই একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতার সূর্য ওঠার আগে পঁচিশে মার্চ রাতটি ছিল ভয়ানক ও বিভীষিকাময়। পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালির স্বাধীনতার প্রত্যয়কে ধ্বংস করতে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যা চালাতে। ‘অপারেশন সার্চ লাইটে’ তারা সেদিন ঢাকা মহানগরের কয়েক হাজার মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল।
আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল রেললাইনের পাশে থাকা বস্তি, ইংলিশ রোড আর নয়াবাজারের কাঠ আর টিনের দোকানগুলোতে, হিন্দু মহল্লা শাঁখারীপট্টিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল ছিল তাদের টার্গেট। ইকবাল হলকে তারা ছাত্রদের প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিয়েছিল। আর হিন্দু ছাত্রদের হল ও তৎসংলগ্ন আবাসিক এলাকাও ছিল তাদের লক্ষ্যবস্তু। জগন্নাথ হলে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দা যারা বেঁচেছিল তাদের দিয়েই তারা ওই লাশগুলো মাটিচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। জগন্নাথ হলের গণকবর এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি বছর পঁচিশে মার্চ ছাত্র-জনতা আলোর মিছিলে ওই গণকবরে এসে প্রদীপ প্রজ্বালন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওই গণহত্যার আর দুটি প্রধান কেন্দ্র ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার। ওই দুই জায়গাতেই অবশ্য তারা পুলিশ আর ইপিআরের বাঙালি সেনাদের প্রচ- প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। ফলে ওই জায়গায় তাদের আক্রমণের প্রচ-তাও ছিল ভয়ানক
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পঁচিশে মার্চে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নিষ্ঠুরতম গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। এই সেদিন পর্যন্ত দেশেও এই দিনটিকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হতো না। প্রতি বছর পঁচিশে মার্চের পত্রপত্রিকায় ওই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের ছবি মুদ্রণ করা হতো। বিবরণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের বহু পরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ দিনটি আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য ইউনেস্কোকে চিঠি দেয়। কিন্তু দেশের সরকার বা পার্লামেন্টের কোনো প্রস্তাব না পাওয়ায় ইউনেস্কো এ ব্যাপারে কোনো কিছু করতে অপারগতা জানায়। নির্মূল কমিটি আর্মেনিয়াসহ যে সব দেশে গণহত্যা হয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে তাদের সহায়তা চাইলে তারাও ওই পূর্বোক্ত বিষয় উল্লেখ করে। ইতিমধ্যে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা’ দিবসে ঘোষণার জন্য জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশ থেকে দাবি উত্থাপিত হলে জাতিসংঘের ২০১৫-এর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতিমধ্যে নির্মূল কমিটি বিভিন্ন দেশ ও পার্লামেন্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল খোদ বাংলাদেশে এই দিনটি গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয় কিনা। উত্তর স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক ছিল। ফলে যেসব দেশ বাংলাদেশের এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আগ্রহী তারাও এ ব্যাপারে তাদের আর আগ্রহ দেখা যায়নি। তাদের প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ নিজেই যখন এ দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে না সেখানে তারা এ ব্যাপারে কীভাবে এগোবে।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাসদের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য শিরিন আখতার জাতীয় সংসদে পঁচিশে মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ ও তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সংসদে প্রস্তাব আনলে ৩৮ সদস্য ওই আলোচনায় অংশ নেন এবং প্রস্তাবটি
সর্বসম্মতভাবে সংসদে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে বঙ্গভবনে নির্মূল কমিটির আয়োজনে ২০১৭-এর ২৫ মার্চ ওই দিবস পালন অনুষ্ঠানে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি উপস্থিত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে পঁচিশে মার্চের ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পায়। এরপর থেকে প্রতি বছর এই দিনটি ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হলেও এবং সরকারের মন্ত্রী কর্মকর্তারা ওই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা বলে এলেও এখনো পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ কখনই করেনি। পার্লামেন্টও তার গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে ওই পঁচিশে মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রস্তাব সংসদের কার্যবিবরণীতেই রয়ে গেছে। আর এখন তো বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ কেবল পঁচিশে মার্চের গণহত্যাকে নয়, আমাদের স্বাধীনতা দিবসের সব আনুষ্ঠানিকতাকে বাতিল করতে বাধ্য করেছে।
(২)
বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। একই সঙ্গে পঁচিশে মার্চের কালরাতের সেই বিভীষিকাময় গণহত্যারও পঞ্চাশ বছর পূরণ হতে চলেছে। কেমন ছিল সেই দিনটি ও রাতটি নতুন প্রজন্ম সে সম্পর্কে বিশেষ জানে বলে মনে হয় না। ভোগবাদী অর্থনীতি, রাজনীতির দুর্নীতি-দুর্বৃত্তপনা দেশ ও বিশ্ব পরিস্থিতি নতুন প্রজন্মকে সব কিছু ভুলিয়ে রাখছে। অবশ্য তার আগেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকান্ড, দেড় দশকের সামরিক শাসন, ওই গণহত্যার সহযোগী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির উপর্যুপরি সরকারের শাসন কেবল ওই গণহত্যাকেলেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।